নিউইয়র্কে জাতিসংঘে স্থায়ী মিশনে মাতৃভাষা দিবস পালিত একুশে আমাদের প্রেরণা এবং আত্মপরিচয়
Related Articles
টনি ও বাংলা অক্ষর নিউ ইর্য়ক থেকেঃ
গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৫২ সালের এই দিনে (৮ ফালগুন, ১৩৫৯) বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে রফিক, সালাম, জব্বার সহ কয়েকজন তরুণ শহীদ হন। ফলে দিনটি ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
কানাডার ভ্যানকুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙ্গালী রফিকুল ইসলাম (মরহুম) এবং আবদুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার জন্য ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। তাদের এই আবেদনের পর গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সহ বিভিন্ন মহলের দাবীর প্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারীকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।
২০১০ সালের ২১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে ‘এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে জাতিসংঘ’ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে উত্থাপন করে বাংলাদেশ। একই বছরের মে মাসে ১১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘের তথ্যবিষয়ক কমিটিতে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে ২১ ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়েছে।
শুরুর প্রথমেই ক্ষুদে শিশু শিশু ফাহমিদা কবিতা শুনে উপস্থিত সকলের মনে দাগ কাটে। দিনটি উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে জাতিসংঘে নিযুক্ত স্থায়ী প্রতিনিধি ড. মাসুদ বিন মোমেন স্বাগত বক্তব্য রাখেন।
বক্তব্যে তিনি বলেন, একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ মানে এক কালজয়ী উপাখ্যান।তিনি বলেন, রক্তের সঙ্গে যেমন হিমগ্লোবিনের সম্পর্ক, তেমনি মাতৃভাষার সঙ্গে মানুষের হৃদস্পন্দনের সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র বাংলার দামাল ছেলেরা ১৯৫২ সালে রুখে দিয়েছিল বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে।
অমর একুশে পালন উপলক্ষে নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে জাতিসংঘের বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন, উডসাইডের গুলশান টেরেসে বাংলাদেশ সোসাইটি, কুইন্স প্যালেসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন, জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় জ্যাকসন হাইটস বাংলাদেশি বিজনেস এসোসিয়েশন (জেবিবিএ–এনওয়াই) এবং ম্যানহাটনে জাতিসংঘের সামনে ড্যাগ হ্যামারশোল্ড পার্কে মুক্তধারা ফাউন্ডেন এবং বাঙালীর চেতনা মঞ্চ অুমর একুশের বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করে।
জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে যথাযোগ্য মর্যাদায় আজ মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়।মিশনের বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়ামে ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টা ৩০ মিনিট থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রহর পর্যন্ত ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠান চলে।এরপর বঙ্গবন্ধু অডিটোরিয়ামে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষা শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরে দিবসটি উপলক্ষে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাণী পাঠ করে শোনানো হয়।রাত সাড়ে দশটার পর শুরু হয় শহীদ দিবস উপলক্ষে উন্মুক্ত আলোচনা।
এতে বলা হয়,যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক ও কলামিস্টসহ বিভিন্ন পেশার বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাঙালির উপস্থিতিতে নিউইয়র্ক সময় ২১ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে মিশনস্থ অস্থায়ী শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পন করে ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়।রাত ১২টা ১মিনিটে মিশনে স্থাপিত শহীদ মিনারে স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেনের নেতৃত্বে মিশনের কর্মকর্তা কর্মচারিবৃন্দ ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
এরপর কনস্যুলেট জেনারেল অফিস, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ, যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সোনালী এক্সচেঞ্জ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ(সিবুল দেবনাথ), কৃষক লীগ, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ (সেবুল মিয়া ও জামাল হোসেন), –
যুক্তরাষ্ট্র ছাত্রলীগ সাজ্জাদ হোসেন, শেখ হাসিনা মঞ্চ ইন্ক (আব্দুল জলিল ও আবুল কাসেম), শেখ রাসেল শিশু–কিশোর সংস্থা (সভাপতি গোলাম এম খান লিপটনও সাধারন সম্পাদক মোঃ আকবর আলী), ম্যানহাটন ব্যুরো যুব লীগ, ব্রোকলিন যুব লীগ, নিউ ইর্য়ক ষ্টেট যুব লীগ, সিলেট এম সি এন্ড গভঃ কলেজ এলমনাই, গোপালগঞ্জ জেলা সমিতিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন এবং উপস্থিত প্রবাসী বাঙালিগণ শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই আমরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। বীর বাঙালি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার লাল সূর্য।’স্থায়ী প্রতিনিধি প্রবাসী বাঙালিদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা দেশের শুভেচ্ছা দূত। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে মাতৃভাষা বাংলার চর্চা এবং বাংলা সংস্কৃতি লালন ও ধারণের মাধ্যমে আপনারা প্রবাসে মহান একুশের চেতনাকে আরও ছড়িয়ে দিতে পারেন।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও সময়োপযোগী নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনষ্টিটিউট বিশ্বের লুপ্ত প্রায় ভাষাগুলোকে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে বলে স্থায়ী প্রতিনিধি উল্লেখ করেন।তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্বে হানাহানি ও অসহিষ্ণুতা থেকে মুক্তির পথ হতে পারে মহান একুশ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনার বাস্তবায়ন।উন্মুক্ত আলোচনা পর্বে উঠে আসে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, ভাষা শহীদদের গৌরবগাঁথা, একুশের চেতনা ও আবহমান বাঙালি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিভিন্ন দিক।
নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল মো: শামীম আহসান, প্রবাসী বাঙালিদের সন্তানদের বাংলা ভাষার অনুশীলন আরও বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।তিনি বরেন, ‘ইংরেজি ভাষাভাষী দেশে ভালো ইংরেজি বলার পাশপাশি ভালো বাংলাও বলতে হবে। তবেই আমরা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকতে পারবো।’ একুশের শোককে আমরা শক্তিতে পরিণত করে এর সুর বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারা বাংলাদেশের জন্য বিস্ময়কর একটি সাফল্য বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ বসারত আলী বলেন, “আজ সারা যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে প্রবাসী বাঙালিগণ মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করছে। এটি কখনই থামবে না। একুশের চেতনা দূর্বার গতিতে আরও সামনে এগিয়ে যাবে”।
যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সামাদ আজাদ বলেন মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের কাহিনী পৃথিবীর সবাই এখন জানে। একুশ আমাদের জাতির চেতনা ও গৌরবের উৎস। একুশ আমাদের অহঙ্কার। আমাদের সামগ্রিক পরিচয়। পৃথিবীতে বাঙালি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো জাতি নেই যে জাতি ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মাহবুবুর রহমান ও লুৎফুল করীম, মুক্তিযোদ্ধা মুকিত চৌধুরী, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ডা: মাসুদুল হাসান, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফারুক আহমেদ,
আব্দুর রহীম বাদশা, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের মুক্তযোদ্ধা সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের প্রবাসী কল্যান সম্পাদক সোলেয়মান আলী, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক এম এ করিম জাহাঙ্গীর, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের উপ–প্রচার সম্পাদক তৈয়বুর রহমান টনি, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নিন্দল কাদের বাপ্পা, যুক্তরাষ্ট্র ষ্টেট আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি এম এ আলমগীর, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের যুক্তরাষ্ট্র মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ শাহনাজ,
আন্তার্জাতিক সম্পাদক সাক্ষায়ত বিশ্বাস, সেচ্ছাসেবক লীগের,সেচ্ছাসেবক লীগের সধারন সম্পাদক সিবুল দেনাথ, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আশরাফুদ্দিন, যুক্তরাষ্ট্র ছাএলীগের সাবেক সভাপতি জেড এ জয়, যুক্তরাষ্ট্র ছাএলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাজ্জাদ হোসেন, ষ্টেট যুবলীগের সেবুল মিয়া ও জামাল হোসেন, সহ বিশিষ্ট প্রবাসী বাঙালীগণ। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধা আব্দুল মুকিত চৌধুরী। বক্তাগণ মহান একুশের চেতনাকে ধারণ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ ও জাতির উন্নয়নকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
সুধীজনদের বক্তৃতায় নতুন প্রজন্মকে মহান ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আরও ব্যাপকভাবে জানতে এবং এরই আলোকে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। তারা বলেন, ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মায়ের ভাষা বাংলা রক্ষার জন্য জীবন দিল রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ নাম না জানা আরো কয়েকজন বীর। রচিত হলো মানবজাতির জন্য এক বিরল ইতিহাস। বাঙালি জাতি মাথা উচু করে দাঁড়াল সবার সামনে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বাঙালির গন্ডি ছাড়িয়ে এই দিবসের অংহকার এখন বিশ্বের ভাষাভাষীর প্রতিটি মানুষের।