মায়াভরা সেই মুখ
Related Articles
এম. নজরুল ইসলাম: সে এক দেবশিশু, যার দুই চোখ জুড়ে ছিল অপার বিস্ময়। সহজাত সারল্য ছিল। ছিল অন্যকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা তার। মা-বাবার মমতায়, ভাই-বোনের ভালোবাসার ভেলায় ভেসে দিন যাচ্ছিল তার। ধানমন্ডির ৩২ নস্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িটির সামনেই লেক। বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে সামনে অনেকদূর চলে যাওয়া যায়। ধানমন্ডি লেকের পাড় আর এই রাস্তা দিয়ে তিন চাকার সাইকেল চালাতে চালাতে একটু একটু করে নিজের চেনা জগতের পরিধি বাড়িয়ে নেওয়ার ভেতর দিয়ে দিন কাটতো তার। বাড়িতে সর্বকনিষ্ঠ হওয়ায় সবার আদর আদায় করা তো ছিলই। স্বাধীনতা-পূর্বকাল থেকে যে বাড়িটি ছিল বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু, সেখানে মানুষের যাতায়াত ছিল অবাধ। বাড়ির কনিষ্ঠ সদস্যটি সব বয়সের মানুষেরও প্রিয়জন হয়ে উঠতে পেরেছিল সহজাত সারল্যে।
কী স্বপ্ন ছিল তার? তাকে নিয়ে পরিবারের সদস্যদের কী স্বপ্ন ছিল, তা জানা যায় না। স্বপ্নপূরণের বয়স ছোঁয়ার আগেই তাকে পাড়ি জমাতে হয়েছে পরপারে। ষড়যন্ত্রকারীদের নির্মম বুলেট বিদ্ধ করেছিল তাকেও। নিষ্পাপ শিশুটি কি বাঁচতে চেয়েছিল? চেয়েছিল নিশ্চয়। পার্থিব পাপ তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। রাজনীতির দাবার চাল বুঝে ওঠার আগেই নির্মমতার শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিল সে। তার মা, সর্বংসহা বঙ্গমাতা আমাদের, ততক্ষণে বুলেটের শিকার হয়েছেন। শিশুটিকেও বাঁচতে দেওয়া হয়নি। ঘাতক বোঝেনি অবুঝ শিশুর মন। ঘাতক বোঝেনি বোনের ভালোবাসাও। ঘাতক কেবল ট্রিগার চালাতে জানে। ঘাতক বোঝে না জাতির ভবিষ্যৎ। বর্তমানের মিথ্যা হিসাব নিয়ে ঘাতকেরা মাতে হত্যার উল্লাসে। অবুঝ শিশুও টার্গেট হয় তার। তাতে যে দীর্ঘ হয়েছে দীর্ঘশ্বাস, সেই কথা ঢের লেখা আছে ইতিহাসে। শুধু লেখা নেই, আড়ালে কাদের বুকে শোকের সাগর বয়ে চলে অবিরাম।
আপন ভূবনে শিশুরা রাজাধিরাজ। এই দেবশিশুও শিশুরাজ্যের রাজা ছিল। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্র হিসেবে ঐ বয়সেই কিছু বন্ধুও ছিল তার। সবার সঙ্গেই তো সদ্ভাব ছিল তার। শিক্ষক ও অন্যদের লেখা থেকে জানা যায়, মানুষকে আকর্ষণ করার অসাধারণ ক্ষমতা তখনই অর্জন করেছিল সে। কিন্তু সে অর্জন কাজে লাগানোর কোনো সুযোগই দেওয়া হয়নি তাকে। জাগতিক কোনো বোধ ছুঁয়ে যাওয়ার আগেই তাকে ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হলো। তবে ঘাতকদের মনেও ভয় জাগিয়েছিল এই শিশুটি? বেঁচে থাকলে একদিন পরিবারের রাজনৈতিক উত্তারিধার বহন করবে সে, ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে ঘাতকদের স্বরূপ উন্মোচনে ভূমিকা রাখবে, এই ভয় থেকেই কি তাকে সরিয়ে দেওয়া হলো পৃথিবী থেকে?
মানসিকভাবে তৈরি হওয়ার আগে থেকেই তো সে দেখেছে বাবার রাজনৈতিক ব্যস্ততা। পরবর্তীতে দেশ গঠনে মনোনিবেশ এ সবই তো তার খুব কাছ থেকে দেখা। ছোটবেলার এই অভিজ্ঞতা কি বড় হয়ে কাজে লাগাতে পারত সে? হয়ত পারত। কিন্তু সুযোগ আসেনি তার কাছে। তার আগেই সে হারিয়ে গেছে। চলে গেছে এমন এক দেশে যেখানে একবার গেলে কেউ আর ফিরে আসে না। তার স্মৃতি শুধু থেকে যায়। সেই স্মৃতি যতই সুখস্মৃতি হোক, আপনজনকে কাঁদায়। যেমন আজকে কাঁদাবে দুই বোনকে।
ছোটএই ভাইটিকে নিয়ে দুই বোনেরও নিশ্চয় অনেক স্বপ্ন ছিল? হয়ত ছিল। আমরা কোনোদিন জানতে পারিনি তা। আমরা জানি এক কালো রাতের কাহিনী। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের এক কলঙ্কময় দিনকে আমরা জানি, যেদিন পূব আকাশে উঠেছিল রক্তমাকা সূর্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। চারদিকে তখন কেবলই গুলির শব্দ। ঘাতকের গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন বাড়ির সব সদস্য। শিশু রাসেল যেতে চেয়েছিল তার মমতাময়ী মায়ের কাছে। তাকে হত্যা করা হবে না, এই অভয় চেয়েছিল সে। কিন্তু অবুঝ শিশু বোঝেনি, ঘাতকের প্রাণে মায়া থাকে না। নির্মমতার শিকার হতে হয় তাকে। কী অপরাধ ছিল শিশু রাসেলের? জাতির জনকের সন্তান এই কি তার অপরাধ!
আজ সেই দেবশিশু শেখ রাসেলের জন্মদিন। আজ দুই বোনের স্মৃতিতে নতুন রাসেল ধরা দেবে। দুই বোন আদরের চিহ্ন এঁকে দিতে ভাইটিকে কাছে পাবে না। শুধু হৃদয়ের সেলুলয়েডে ধরে রাখা ছবিগুলো তাঁদের চোখে আনবে অশ্রুর বন্যা। ছোট ভাইটির মায়াভরা সেই মুখ তাঁদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। সে বেদনা বইবার ভার কেবলই তাঁদের!
লেখক: অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকার কর্মী, লেখক ও সাংবাদিক