দেশের জ্বালানি সংকট মোকাবেলা ও নাগরিক দায়িত্ব!

Awamileague Times
By Awamileague Times আগস্ট ১, ২০২২ ১৪:৫২

দেশের জ্বালানি সংকট মোকাবেলা ও নাগরিক দায়িত্ব!

শিব্বীর আহমেদ: শতভাগ বিদ্যুৎতায়নের দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের বেশির ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র জ¦ালানি তেলের উপর নির্ভরশীল। এই জ্বালানি তেলের আমদানি স্বাভাবিক ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পূর্বে। কিন্তু ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ৩১ জুন রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ করার ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলো ঐকমত্যে পৌঁছানোর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের তেলের বাজারে দ্বিতীয়বারের মত অস্থিরতা শুরু হয়েছে। আর এর ঢেউ স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশের জ্বালানি তেলের বাজার এবং তেল আমদানিতে সংকট সৃষ্টি করেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৎ, আন্তরিক ও দূরদর্শী নেতৃত্বে মানসম্মত ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সুবিধা বাংলাদেশের জন্য এখন আর স্বপ্ন নয়। দেশের প্রায় শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পেয়েছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর বিদ্যুৎকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে ঘোষণা করে ২০২১ সালের মধ্যে সকল পরিবারের বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করে। ২০০৯ সালে মাত্র ৪৭ শতাংশ থেকে ২৫,২৩৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার সঙ্গে সরকার সফলভাবে তার ভিশন ২০২১ অর্জন করে, যা ২৪,০০০ মেগাওয়াটের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দৃঢ় ভিত্তি রচনার পর সরকারের পরবর্তী লক্ষ্য হল ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০,০০০ মেগাওয়াাট এবং ২০৪১ সালে বাংলাদেশ যখন একটি সমৃদ্ধ উন্নত দেশে পরিণত হতে চায় ততদিনের মধ্যে ৬০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল হল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে ‘সাফল্যের যুগ’। এ সময়টাতে তিনি বাংলাদেশের পুরো চেহারা বদলে দিয়েছেন।

শিব্বীর আহমেদ, সাংবাদিক

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৎ, আন্তরিক ও যোগ্য নেতৃত্বে কাজ করে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বেড়ে ১৪৬-এ উন্নীত হয়েছে। অথচ ২০০৯ সালে এটি ছিল মাত্র ২৭। উৎপাদন ক্ষমতা ২৫,২৩৫ মেগাওয়াটে (ক্যাপ্টিভসহ) পৌঁছেছে, যা ২০০৯ সালে ছিল ৪,৯৪২ মেগাওয়াট (ক্যাপ্টিভসহ)। শুধু তাই নয়, সমস্ত পাওয়ার ক্যাবল এবং সাবস্টেশনকে মাটির নিচে নেয়ার জন্যও কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার। নবায়ণযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অংশ ২০৫০ সালের মধ্যে মোট উৎপাদন ৪০ শতাংশে উন্নীত করতে চায় শেখ হাসিনা সরকার।

সৌর বিদ্যুৎ অন্যান্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের তুলনায় অনেক ভালো এবং সরকার ছাদে সৌর এবং ভাসমান সৌর প্রযুক্তির দিকে এগোচ্ছে। এছাড়া ছাদে সৌরবিদ্যুৎ জনপ্রিয় করতে নেট মিটারিং সিস্টেম চালু করা হয়েছে এবং বায়ুশক্তির সাহায্যে আরও বিদ্যুৎ উৎপাদনেরও সুযোগ তৈরি হয়েছে। সরকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ২৮, ০৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে, যা ২০০৮-২০০৯ সালে ছিল মাত্র ২,৬৭৭ কোটি টাকা।

কিন্তু গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার পর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে তেলের দাম। এক পর্যায়ে প্রতি ব্যারেল ১৩৯ ডলারে গিয়ে ঠেকেছিল। এরপর থেকে বিভিন্ন উদ্যোগে ওঠানামার মধ্যেই তেলের দর ১১০ থেকে ১১৫ ডলারের মধ্যে ছিল। গত মে মাসের শেষের দিকে তেলের দাম অল্প করে বেড়ে ৩০ মে ১২০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। বিশেষ করে তেল আমদানি বন্ধ করার ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলো ঐকমত্যে পৌঁছানোর পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ মে বিশ্বের অপরিশোধিত তেলের দাম উঠে যায় প্রতি ব্যারেল ১২৫ ডলার।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সারবিশ্বে তেলের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু রশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ করার ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সিদ্ধান্তের ফলে রাশিয়া থেকে তেলের আমদানী প্রায় বন্ধের মত। ফলে বিশ্ব পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারকে বিদ্যুৎ সাস্ত্রয়ী পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি তেল অপরিহার্য্য এবং তেলের স্বাভাবিক প্রবাহ এখন আর না থাকার ফলে সারাবিশ্বের সকল দেশের সকল সরকারকেই নানা পদক্ষেপ গ্রহন করতে হচ্ছে। শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের দেশ বাংলাদেশ। কিন্ত এই শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার জন্য জ্বালানি তেলের আমদানী অত্যাবশ্যকীয় যা এই মুহুর্তে সারবিশ্বেই ব্যাহত। এটা বিষয়টি সবাইকে বুঝতে হবে এবং এই বিষয়কে মাথায় রেখেই বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হবে।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম ক্রমবর্ধমান হওয়ার কারণে সৃষ্ট বিদ্যুৎ সংকট কমাতে সরকার এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং এবং ডিজেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা সহ বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১৯ জুলাই থেকে এক ঘণ্টা বিদ্যুতের লোডশেডিং থাকবে এবং ডিজেল চালিত প্ল্যান্টে উৎপাদন সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি একটি সময়োপযোগী রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত এবং দেশকে রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি সুচিন্তিত ভিষনারী সিদ্ধান্ত। সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে ‘বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রায় ১,০০০ মেগাওয়াট থেকে ১,৫০০ মেগাওয়াট ঘাটতি হবে। ফলে কর্তৃপক্ষ সারাদেশে পর্যায়ক্রমে এক থেকে দুই ঘণ্টা বিদ্যুতের লোডলোডশেডিং করতে বাধ্য হয়েছে। দেশে ফিলিং স্টেশনগুলোও সপ্তাহে এক দিন বন্ধ রাখা হবে। এই সিদ্ধান্ত সাময়িক। বৈশ্বিক পরিস্থিতির উন্নতির পরপরই আবারো সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ফিরে যাবার পরকিল্পনা সরকারের। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সরকার জ¦ালানি তেলের খরচ কমাতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। শুধু বাংলাদেশেই নয়, যুক্তরাজ্য অস্ট্রেলিয়ার মতো অন্যান্য ধনী দেশও পরিস্থিতি সামাল দিতে লোডশেডিং করছে অন্যান্য দেশের সরকার।

শিল্প খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বিদ্যুৎ বিভ্রাট কখন, কোন এলাকায় হবে, আমরা তা আগাম জানিয়ে দেবে সরকার। আগামী এক সপ্তাহে দেশে এক থেকে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং হবে এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষ নেবে। এছাড়াও দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে গ্যাস না কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। দেশে বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ১০ শতাংশ ডিজেল ব্যবহৃত হয়, বাকিটা পরিবহন খাতে ব্যবহৃত হয় এবং ডিজেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখার ফলে সরকার যথেষ্ট পরিমাণ পেট্রোল বাঁচাতে সক্ষম হবে। সরকার সরকারি অফিস সময় কীভাবে কমানো যায় তাও বিবেচনা করছে সরকার।

পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবশালী থিংকট্যাংক কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস তাদের গবেষণা প্রতিবেদেন জানিয়েছে, রাশিয়ার তেলের ওপর ইউরোপের এই নিষেধাজ্ঞায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে উভয়পক্ষই। তবে রাজনৈতিকভাবে রাশিয়ার থেকে ইউরোপের ক্ষতি হবে বেশি। রাশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম তেল রফতানিকারক দেশ। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে রাশিয়ার তেল উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১৩ লাখ ব্যারেল প্রতিদিন। এর মধ্যে প্রতিদিন তাদের রফতানি ছিল ৭৮ লাখ ব্যারেল তেলের মধ্যে অপরিশোধিত তেল ছিল ৫০ লাখ ব্যারেল। রাশিয়ার তেল রফতানির ৬০ ভাগ যায় ইউরোপে ২০ ভাগ চীনে এবং অবশিষ্ট ২০ ভাগ যায় সারা বিশ্বে।

করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বজুড়ে নানা দেশগুলোকে অর্থনৈতিক সংকটে ফেলে দিয়েছে । অনেক দেশ দেউলিয়া হওয়ার পথে। সম্প্রতি অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে শ্রীলঙ্কা। এমন অর্থনৈতিক সংকটের মুখে শুধুমাত্র দ্বীপারাষ্ট্রটি নয়, বিশ্বের প্রায় ১২টি দেশ আর্থিক সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইতিমধ্যে উন্নয়নশীল অনেক দেশ আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছে। কিন্তু থেমে নেই দেশগুলোর আর্থিক সংকট, যা এখন চরমে পৌঁছে যাচ্ছে। সংকটের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে আর্জেন্টিনা, পাকিস্তান, ইউক্রেন, বেলারুশ, তিউনিশিয়া, ঘানা, মিশর, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, ইথিওপিয়া, ইকুয়েডর এবং এল সালভাদর সহ অন্যান্য দেশ। কিন্তু আল্লাহ’র রহমত এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত এখনো বাংলাদেশকে সংকটের মুখমুখি পড়তে হয়নি। কিন্তু ভবিষ্যতেও যাতে বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলংকার মত না হয় সেজন্য দেশের সকল নাগরিকের সুশৃংখল সময়োপযোগী আচরন প্রয়োজন। সংকট মোকাবেলায় সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন। কোন ধরনের উস্কানী বা ভুঁয়া তথ্য ছড়িয়ে সরকার, দেশ ও সর্বোপরি নিজেদেরকে বিপদের সম্মুখীন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। মনে রাখাতে হবে বাংলাদেশ সংকটে পড়লে দেশের সকল নাগরিককে এই সংকট মোকাবেলা করতে হবে।

পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য ইতিমধ্যে আইএমএফ ও অন্য দেশের সরকারের দ্বারস্থ হয়েছে। বাংলাদেশকেও যাতে এই পরিস্থিতিতে পড়তে না হয় সেজন্য সরকারি ব্যয়ের বিষয়টিকে পুনঃ অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং ভোক্তা পর্যায়ে কেনাকাটার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। বাংলাদেশে গত মে মাসে মুদ্রাস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৪২ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়ায় জরুরি নয় এমন পণ্য আমদানি বন্ধ করতে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স পেতে বিভিন্ন বিধান শিথিল করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের বিদেশে ভ্রমণও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় লোডশেডিং এর ঘোষনা দিয়েছে সরকার। এখন দায়িত্ব জনগনের সরকারের পাশে দাঁড়ানো এবং সরকারকে সহযোগিতা করা। যাতে বাংলাদেশ এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে।

– শিব্বীর আহমেদ, সাংবাদিক
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

Awamileague Times
By Awamileague Times আগস্ট ১, ২০২২ ১৪:৫২

  • Sorry. No data yet.
Ajax spinner